বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫,
১৯ ভাদ্র ১৪৩২
বাংলা English हिन्दी

বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ধর্ম
সুরা কাউসারের মর্ম ও তাৎপর্য
অনলাইন ডেস্ক
Publish: Friday, 22 August, 2025, 9:00 AM

পবিত্র কুরআনের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ততম সুরার নাম আল-কাউসার। আল-কাউসার অর্থ ‘প্রভূত কল্যাণ’, ‘অঢেল প্রাচুর্য’ ইত্যাদি। তবে আল-কাউসার শব্দের গভীরে গভীরতর আরেকটা অর্থ নিহিত আছে। দুঃখ-সুখের দ্যোতনায় সে অর্থ বড়ই চমৎকার। জান্নাতে যে অপরূপ সৌন্দর্য ও অনাবিল সুষমার সমাবেশ থাকবে, তার সিকিভাগও আমরা কল্পনা করতে পারি না। নয়নাভিরাম সেই জান্নাতে অনিন্দ্যসুন্দর একটা নদী প্রবাহিত হবে। যার দুই তীর থাকবে স্বর্ণখচিত। বহতা সে নদীর জল প্রবাহিত হবে মণি-মুক্তা, ইয়াকুত ও মসৃণ পাথরের ওপর দিয়ে। সেই নদীর পানি মেশকের চেয়েও সৌরভময়। মধুর চেয়েও মিষ্টি আর বরফের চেয়েও শুভ্র ও স্বচ্ছ। এই নদীতে এমন সব পাখি জলকেলিতে মগ্ন হবে যেগুলোর ঘাড় উটের ঘাড়ের মতো স্ফীত। সুস্বাদু এই পাখির মাংস খাওয়ার সৌভাগ্য তাদেরই হবে যারা নেহায়েত কোমল মনের মানুষ। কুরআনের সুরা কাউসারে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, কল্পনাকেও হার মানানো এই অপরূপ শোভাময় নদীটি তিনি মহানবী (সা.)-কে দান করেছেন।

কেয়ামতের পরে সবাইকে একটা বিশাল প্রান্তরে সমবেত করা হবে। সময়ের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে হাজির হওয়ার পর সবার সামনে অপরিচিত ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বিরাজ করবে। ভয়, উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনায় সবাই অস্থির হয়ে থাকবে। বুকফাটা তৃষ্ণা আর অনন্ত পিপাসায় কাতর হয়ে পড়বে সবাই। বিশৃঙ্খল, বিভীষিকাময় আর উদ্বেগভরা এই পরিস্থিতিতে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য সবাই দিগি^দিক ছোটাছুটি শুরু করবে। তখন আল্লাহ তায়ালা মহানবী (সা.)-কে দায়িত্ব দেবেন দিশাহারা এই মানুষগুলোকে পানি পান করানোর জন্য। নবীজি (সা.) হাউসে কাউসার থেকে তাদের অনন্ত পিপাসা মেটানো শুরু করবেন। 

হাউসে কাউসার একটি পবিত্র জলাধার। মুক্তা দিয়ে যার তীর বাঁধাই করা। তলদেশ স্ফটিকস্বচ্ছ মুক্তার পাথরকুচি দিয়ে ভরপুর। মেশকের সুরভিতে তার চারপাশ মোহিত হয়ে থাকবে অবিরাম। জান্নাতের সেই বর্ণিল কাউসার নদী থেকে স্বর্ণ ও রুপার দুটি পরনালা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এই জলাধার জলে টইটম্বুর হয়ে উঠবে। এই হাউসের দৈর্ঘ্য হবে এক মাসের পথ। প্রস্থও হবে সমান দূরত্বের। এর পাশে থাকা পানপাত্রগুলোর সংখ্যা হবে আকাশের তারকারাজির সমপরিমাণ। একবার যে এখান থেকে পানি পান করবে, জান্নাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না।

কেন দেওয়া হলো আল-কাউসার? নবুয়ত প্রাপ্তির পর নবীজি (সা.) সর্বতোভাবে দাওয়াতি কাজে আত্মনিয়োগ করেন। শিরক, প্রতিমাপূজা আর অমানবিকতার বিরুদ্ধে তিনি জোরালো বক্তব্য রাখেন। যতই দিন গড়াতে থাকে, ইসলামের প্রতি মানুষের আকর্ষণ ততই বাড়তে থাকে। ইসলামের নৈতিক ও মানবিক আদর্শে মুগ্ধ হয়ে নিপীড়িত ও সমঝদার লোকজন ঈমানের নুরানি কাফেলায় শরিক হতে থাকে। ধীরে ধীরে প্রলম্বিত হতে থাকে তাওহিদবাদী মানুষের নীরব মিছিল। যার ফলে নবীজি (সা.)-এর দ্বীনি দাওয়াতকে মক্কার নেতৃস্থানীয় মুশরিকরা ভালোভাবে নিতে পারেনি। ইসলামকে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব ও সামাজিক আধিপত্যের জন্য স্পষ্ট হুমকি মনে করতে থাকে। এ কারণে তারা নবীজি (সা.)-কে দমন করতে সব ধরনের কূটকৌশলের পথ বেছে নেয়। তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, দাওয়াতি কাজে বাধা প্রদান এবং তাঁর অনুসারীদের পৈশাচিক নির্যাতন করা হয়ে ওঠে তাদের নিত্যদিনের কাজ। নবীজি (সা.)-এর প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে কুরাইশের নেতৃস্থানীয় মুশরিকরা বলত, মুহাম্মদ তো নিজের জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাঁর অবস্থা হয়েছে শেকড় কাটা গাছের মতো। যা কিছু দিনের মধ্যেই শুকিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। এসব ব্যাপারগুলো নবীজি (সা.)-কে মানসিকভাবে ভীষণ পীড়া দিত। কিন্তু তাই বলে মুহূর্তের জন্যও তিনি দমে যাননি। বাধা যত প্রবল হতে থাকে, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁর দাওয়াতি কাজও বেগবান হতে থাকে।

ঠিক এই সময়টাতে একে একে নবীজি (সা.)-এর দুজন পুত্রসন্তান ইন্তেকাল করেন। হৃদয়ের রত্ন সন্তানের মৃত্যুতে একজন স্নেহপরায়ণ পিতা হিসেবে নবীজি (সা.) মানবিক বেদনায় বিমর্ষ হয়ে পড়েন। বিষণ্নতার এই নিদারুণ মুহূর্তেও তিনি নীরব হয়ে বসে থাকেননি। ঐশী প্রসন্নতা আর তকদিরের ওপর অবিচল আস্থা নিয়ে দাওয়াতের কাজে অভাবনীয় গতিশীল হয়ে ওঠেন। কাফেররা সুযোগ পেয়ে তাকে আরও বিষাক্ত বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে থাকে। যার ঘরে কোনো পুত্রসন্তান টেকে না, তাকে আরবের লোকজন বলত আবতার; নির্র্বংশ। এবার কাফেররা নবীজি (সা.)-কে ‘আবতার’ (লেজ কাটা বা নির্বংশ) বলে তাচ্ছিল্য ও আঘাত করা শুরু করে।

মুশরিক সর্দার আস বিন ওয়ায়েল ছিল ঠোঁটকাটা কিসিমের লোক। একদিন সে নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে কোনো একটা ব্যাপারে কিছু কথা বলছিল। পরে অন্য মুশরিকরা তাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছিলে? আর কী কথাই বা বলছিলে? আস বিন ওয়ায়েল তখন খুবই তাচ্ছিল্যভাব নিয়ে বলে, ওই নির্বংশ লোকটার সঙ্গে। আরে! তাঁর কথা তোমরা বাদ দাও তো। তাঁর কোনো পুত্রসন্তান নেই। মৃত্যুর পর তাঁর নাম নেওয়ার মতো কোনো লোকই পৃথিবীতে থাকবে না। তখন তাঁর এসব অযথা কাজকর্মও কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। আর আমরাও বেঁচে যাব তাঁর উৎপাত থেকে।

আরেকবার মদিনার ইহুদি সর্দার কাব বিন আশরাফ মক্কায় আগমন করে। তখন মুশরিক নেতারা তার কাছে সমবেত হয়ে বলে, কাব! ওই ছোকরার ব্যাপার-স্যাপারটা দেখো তো! সে তার জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আবার সে নিজেকেই সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করছে। অথচ আমরা হাজিদের উত্তরসূরি, কাবা ঘরের তত্ত্বাবধায়ক এবং জমজম কূপের দেখভাল করি। কাব তখন বলে, সে কেন শ্রেষ্ঠ হতে যাবে? তোমরাই তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এভাবে আবু জাহেল, আবু লাহাব প্রমুখ নেতাও নবীজি (সা.)-কে নির্বংশ, জাতি বিচ্ছিন্ন ইত্যাদি হেয়কর শব্দে লাঞ্ছিত করত। সামান্য সুযোগও তারা কখনো হাতছাড়া করত না। 

কাফেরদের এমন নানামুখী তাচ্ছিল্য, উপহাস ও কটুবাক্যে নবীজি (সা.) ব্যথিত হতেন। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কষ্টের কুয়াশা আর বেদনার মেঘ ছাড়া কিছুই তাঁর চোখে পড়ত না। রাতের গভীরে মহান মালিকের সঙ্গে ভালোবাসার নীরব আলাপনে এই দুঃখগুলো ঝরে ঝরে পড়ত। এমনই হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে আল্লাহ তায়ালা নবীজি (সা.)-এর ওপর সুরা কাউসার নাজিল করেন। যেখানে হারানোর বিপরীতে বিশাল প্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে। যে প্রাপ্তি নিছক পার্থিব বা বস্তুগত নয়, বরং অপার্থিব ও অবিনাশী। প্রভূত কল্যাণ আর অঢেল প্রাচুর্যে ভরপুর। যেখানে কাফেরদের তাচ্ছিল্য আর উপহাসের অপনোদন করে নবীজি (সা.)-কে সান্ত্বনাবাণী শোনানো হয়েছে। বলা হয়েছে, তুমি নির্বংশ নও; বরং তোমার নিন্দুক ও দুশমনরাই নির্বংশ হবে।

ঐশী এই বাণী নিছকই ঘোষণা বা সান্ত্বনা নয়। এই ঘোষণা মহাসত্যের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে প্রতিফলিত হয়েছে। একদিকে কন্যার মাধ্যমে নবীজি (সা.)-এর বংশধারা আজ অবধি পৃথিবীতে অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে তাঁর আধ্যাত্মিক সন্তান তথা উম্মতের সংখ্যা তো বলাই বাহুল্য। যাদের সংখ্যা অন্যান্য সব উম্মতের সামষ্টিক সংখ্যার চেয়েও বেশি হবে। তা ছাড়া প্রতিটি মুহূর্তে সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে নবীজি (সা.)-এর নাম যে কত শতবার উচ্চারিত হয় তার সঠিক হিসাব কে রাখে? পক্ষান্তরে সেই নরাধম কাফেরদের নাম কেবলই ইতিহাসের পাতায় ঘৃণাভরে ঠাঁই পেয়েছে। তাদের কোনো বংশধর আছে কি না তা বলা মুশকিল। থাকলেও সেই পরিচয় কেউ ধারণ করে না। কারও অন্তরে তাদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই, ভক্তি নেই। ওইসব জঘন্য নামে কেউ নিজের সন্তানের নাম তো দূরের কথা, ঘরের জন্তু জানোয়ারের নামও রাখে না। কখনো সেসব নাম উচ্চারিত হলেও অভক্তি আর ঘৃণার শেষ থাকে না। এভাবেই সত্যের পথের পথিকরা মহাকালের সীমানা পেরিয়ে মহামানব হয়ে ওঠেন। আর সত্যের বিরোধীরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ঘৃণাভরে নিক্ষিপ্ত হয়। 

লেখক : আলেম ও প্রাবন্ধিক

ডার্ক টু হোপ/এসএইচ
মতামত লিখুন:
https://www.darktohope.org/ad/1731844310_left-banner.gif

সর্বশেষ সংবাদ

বুয়েট শিক্ষার্থীদের নতুন কর্মসূচি, শুক্রবার চট্টগ্রামে মহাসমাবেশ
নিলামে ৪৭.৫০ মিলিয়ন ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক
সহকর্মীর সঙ্গে প্রেম, নেসলের সিইও লরেন্ট ফ্রেইক্স বরখাস্ত
নেপাল সফরে বাংলাদেশ দলে থাকছেন না হামজা চৌধুরি
নুরকে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার
ধর্ম- এর আরো খবর
Email: [email protected]
© 2024 Dark to Hope
🔝