বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫,
২৫ আষাঢ় ১৪৩২
বাংলা English हिन्दी

বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫
মতামত
জন্মদাতাকে অস্বীকারকারীকে বেজন্মা বলে
অশ্রু হাসি
Publish: Wednesday, 25 June, 2025, 1:51 AM
আজ ২৩ জুন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এই দল জন্মলগ্ন থেকেই বহু প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। হতদরিদ্র দেশকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত করেছে। এতো কঠিন এক সময়ে এই বিশেষ দিনটিকে অবহেলা করা অন্যায় মনে করে এই সাদামাটা লেখাটি লিখছি।

১৯৪৭ সালে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বসবাসের লক্ষ্য নিয়ে এই দেশের মানুষ ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন-শোষণের অবসান ঘটিয়ে এক বুক আশা নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানিদের অন্যায্য আচরণ ও বৈষম্য মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মাওলানা ভাষানী, শামসুল হক, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান ও এয়ার মোহাম্মদ খান-এর নেতৃত্বে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানিরা জোর করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা করে এবং বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করায় বাঙালিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কারণ, তখন পাকিস্তানে সাড়ে সাত কোটিরও বেশি বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ছিল, যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু ও অন্যান্য ভাষাভাষী মিলিয়ে জনসংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ কোটি। বাঙালিদের মনে তখন প্রশ্ন জাগে— যদি কোনো ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়, তবে তা বাংলাই হওয়া উচিত। এই দাবিতে ছাত্র-জনতা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অত্যন্ত নির্মমভাবে সেই আন্দোলন দমনে গুলি চালায় এবং সালাম, বরকতসহ বহু ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে। ফলে গোটা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

বাণিজ্য, শিল্প, আমদানি-রপ্তানিতে বাঙালিদের অবহেলা করা হতো। আমদানি লাইসেন্স বঞ্চিত করে উর্দুভাষীদের দেওয়া হতো, শিল্প কারখানা স্থাপনে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অর্থায়ন করায় মানুষের মাঝে ক্ষোভ জন্ম নেয়। সেনাবাহিনী, পুলিশ, সরকারি চাকরিতে উর্দুভাষীদের প্রাধান্য ও বাঙালিদের বঞ্চনার কারণে অসন্তোষ চরমে পৌঁছায়। তবে এক শতাংশেরও কম কিছু বাঙালি ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে এই বৈষম্যকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে চেষ্টা করতেন।

ভাষা আন্দোলনে হত্যাকাণ্ড এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের অবিশ্বাস্য আচরণে আওয়ামী মুসলিম লীগ একমাত্র দল হিসেবে প্রতিবাদে নামে। এসময় বাঙালিদের 'আধা মুসলিম' বলে উপহাস করা হতো, বাংলা ভাষাকে মুসলমানদের ভাষা নয় বলে বিভেদ সৃষ্টি করা হতো। ফলে রাষ্ট্রে বহু মাত্রিক সামাজিক বিভাজন তৈরি হয়, যা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই বিভাজনের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে ১৯৫৫ সালে মাওলানা ভাষানী ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে 'আওয়ামী লীগ' রাখা হয়।

ভাষানী সাহেব দলীয় নেতৃত্ব দিলেও শেখ মুজিব তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন, বারবার জেলে যান, অত্যাচারিত হন, কিন্তু আপস করেন না। সময়ের সাথে সাথে বাঙালির ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে, আর শেখ মুজিবের প্রতিবাদ আরও তীব্র হয়।

১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে ভাষানী সাহেব সমাজতন্ত্রের সমর্থনে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)’ গঠন করেন। ওই বছর পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এরপর মাওলানা তর্কবাগীশ ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাহোর কনফারেন্সে বাঙালির শোষণের অবসানে ‘ছয় দফা’ উপস্থাপন করেন। এটি অল্প সময়েই বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ছয় দফার পক্ষে অবস্থান নেয়, এবং শেখ মুজিবকে প্রাণের নেতা হিসেবে গ্রহণ করে। তাঁর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে পাকিস্তান সরকার ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে এবং তাঁকে দীর্ঘদিন জেলে রাখা হয়। তখন দেশজুড়ে গণআন্দোলন শুরু হয় এবং এর চাপে পাকিস্তানি সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উল্লাসে শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি লাভ করেন।

১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০টিতে বিজয়ী হয়। পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হয়েও বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও দমন শুরু করে। এই প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে প্রতিরোধের আহ্বান জানান এবং ২৫শে মার্চ রাতের গণহত্যার পর ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপর শুরু হয় নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ, যেখানে ৩০ লাখ শহিদ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় — আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই।

স্বাধীনতার পর, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে এসে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশকে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। দেশের উন্নয়নে সেনাবাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলার কাজে বেশি ব্যবহারের পরিবর্তে ‘রক্ষীবাহিনী’ গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল জাতির কল্যাণের জন্য।

১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ১২০ ডলার। মুক্তিযুদ্ধের পর তা নেমে আসে ৯৩ ডলারে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সময় মাথাপিছু আয় ছিল ১২৮ ডলার — যা পাকিস্তান ২৩ বছরেও অর্জন করতে পারেনি। এরপর ২১ বছরে, ১৯৯৫ সালে তা হয় ৩২৯ ডলার।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে এসে পাঁচ বছরে ১৬০০ মেগাওয়াট থেকে ৪৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, বয়স্ক ও স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি, গ্রামীণ যোগাযোগ উন্নয়নসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২০০০ সালে মাথাপিছু আয় পৌঁছায় ৪১৫ ডলারে।

২০০৯ থেকে ২০২৪ — এই ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে ২৮২৪ ডলারে উন্নীত করে। বিদ্যুৎ শতভাগ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, যোগাযোগে বিপ্লব, বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা, নারী ক্ষমতায়ন, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ ব্যাপক সাফল্যের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বে পরিচিত করে তোলে। দারিদ্রতা ১৮ শতাংশের নিচে এবং অতিদারিদ্রতা ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হয়। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, আন্ডারগ্রাউন্ড রেল, কর্ণফুলী টানেল, ডাবল রেলসেতু, স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট সংযোগ — এসব অর্জন আওয়ামী লীগ শাসনামলেই সম্ভব হয়। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন চলমান ছিল।

এবং সেই আওয়ামী লীগই ২০২৫ সালে নিষিদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের ত্যাগে অর্জিত যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীনতা এসেছে, উন্নয়ন হয়েছে — সেই দলকে অস্বীকার করা মানেই বাংলাদেশকে অস্বীকার করা।

যিনি বাংলার দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেশকে সম্মানের জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন, তিনি স্বৈরাচার! অথচ যারা জাতিকে হানাহানি, মারামারি, বিভেদে ফেলে নতুন প্রজন্মকে বিপথে চালিত করছে, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ও মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘মব বাহিনী’ দিয়ে অপমান করছে, দেশকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে — তারা সম্মানিত!

শিল্পকারখানা ধ্বংস হচ্ছে, কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে, মানুষ হতাশ।

এই অবস্থায় যতই নিপীড়ন চলুক, আওয়ামী লীগকেই দায়িত্ব নিতে হবে — বাংলার মানুষকে আবার জাগাতে হবে। ১৮ কোটি মানুষকে বাঁচাতে হবে, কারণ দেশের সব শত্রু এক হয়েছে। আওয়ামী লীগকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে — দেশের জন্য, মানুষের জন্য, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হবে।

“জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।”
মতামত লিখুন:
https://www.darktohope.org/ad/1731844310_left-banner.gif

সর্বশেষ সংবাদ

গুজরাটে সেতু ধসে নদীতে পড়ে ৯ জনের মৃত্যু
খুলনার সাবেক মেয়র খালেক ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন, আতঙ্কে কয়েক’শ পরিবার
মীরসরাইয়ে নিষিদ্ধ মেলখুম ট্রেইলে পড়ে দুই পর্যটকের মৃত্যু, আহত ৩
শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ৭ দিনের রিমান্ডে
মতামত- এর আরো খবর
Email: [email protected]
© 2024 Dark to Hope
🔝