আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে যতই অল্প সংখ্যক লোক সমবেত হোক না কেন, পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে সেই প্রচার দেখে নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট ও লজ্জিত মনে হয়। কেননা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের অর্থ হলো সেই ভিত্তিকে অস্বীকার করা যার ওপর বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। এই দলটির নেতৃত্বেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছি। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা মানে সেই ইতিহাস এবং আত্মদানকে অপমান করা। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জন্মের ইতিহাসকেই অস্বীকার করা।
আমি বা আমরা দেশকে মায়ের মতোই ভালোবাসি। ছাত্রজীবন থেকেই আমার রাজনীতির হাতেখড়ি। দেশকে মা মনে করতাম এবং বঙ্গবন্ধুকে মনেপ্রাণে জাতির পিতা হিসেবে বিশ্বাস করতাম। যদি বাংলাদেশকে স্বীকার করি-তাহলে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কোনো অপমানজনক কথা বা মন্তব্য শুনলে হৃদয়ে গভীর কষ্ট অনুভব করতাম।
বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত করার পর ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে আসছিলেন, তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ সকল প্রোটোকল ভেঙে বিমানবন্দরে সশরীরে উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেছিলেন, “We are truly delighted to have the opportunity to welcome such a great leader of humanity.” (মানবতার এমন মহান নেতাকে স্বাগত জানানোর সুযোগ পেয়ে আমরা সত্যিই আনন্দিত।)
আমরা এই দৃশ্য অত্যন্ত গর্বের সাথে উপভোগ করেছিলাম। শুধু আমরা নই, ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি সারা বিশ্ব আমাদেরকে বীরের জাতির মর্যাদা দিয়েছিল। আর আজ যখন সারা বিশ্বের মানুষ দেখে যে- আমরা যাকে জাতির পিতা বলেছি, যে দেশকে মায়ের মতো ভালোবেসেছি, এখন সেই জাতির পিতাকে অসম্মান করছি এবং মাকে কলঙ্কিত করছি, তখন বিশ্ববাসী আমাদেরকে কেমন জাতি ভাববে? দেখুন, ৭০-৮০ বছর আগে কায়েদে আজম মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানের জাতির পিতা এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বে মহাত্মা গান্ধী ভারতের জাতির পিতা হয়েছিলেন। এরপর অনেক দল ক্ষমতায় এসেছে এবং গেছে, কিন্তু পাকিস্তান ও ভারতের মুদ্রায় আজও তাদের জাতির পিতার ছবি অক্ষুণ্ন রয়েছে। প্রায় ৩০০ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে স্বাধীন হয়েছিল এবং তার ছবি ডলার থেকে আজও সরানো হয়নি। কেউ তাদের জাতির পিতাকে এক মুহূর্তের জন্যও অসম্মান করতে দেয়নি। আর আমরা টাকা থেকে জাতির পিতার ছবি সরিয়ে কী প্রমাণ করেছি? আমরা কি কুলাঙ্গার জাতি? নাকি অসভ্য জাতি? পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ কি মনে মনে হাসছে না যে আমরা বেইমান জাতি?
স্বাধীনতা আমাদের কী দেয়নি? ১৯৭১ সালে মাথাপিছু আয়, শিক্ষার হার, সামাজিক ন্যায়বিচার, গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, দারিদ্র্যের হার ও কর্মসংস্থানের দিক থেকে আমরা পাকিস্তানের তুলনায় বহু পিছিয়ে ছিলাম। কিন্তু ২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২৭৯৩ ডলার, যেখানে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় মাত্র ১৫৪৭ ডলার। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল সূচকে বাংলাদেশ আজ পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভালো অবস্থানে পৌঁছেছে। এত অর্জনের পরও কি স্বাধীনতার কোনো মূল্য নেই? জাতির পিতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দলকে নিষিদ্ধের দাবি কি পৃথিবীর মানুষের কাছে অত্যন্ত অদ্ভুত মনে হয় না?
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবনের সামনে জমায়েত করা হয়েছে। সেখানে নির্বিঘ্নে মঞ্চ তৈরি করে হইচই, বক্তৃতা ও বিকট শব্দ করা হচ্ছে, কিন্তু কেউ বাধা দিচ্ছে না। এই বাড়িতে সরকার প্রধান থাকেন। এটি কোনো দাবি আদায়ের সমাবেশস্থল নয়। এই বাড়ির নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্নে বসবাসের পরিবেশ নষ্ট করা উচিত নয়, কিন্তু প্রশাসন নির্বাক। দেখে মনে হয়, এখানকার সকল আয়োজন সরকার প্রধানের ইচ্ছাতেই হয়েছে। প্রথমে প্রায় দু’শো লোক ছিল, ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। আয়োজনস্থল থেকে মোবাইলে ফোন করে দূর থেকে অন্যদেরকে দ্রুত যমুনা ভবনের সামনে আসার জন্য ধমকানো হয়। কাউকে কাউকে অনুরোধ করতেও শোনা যায়, যেন তারা সবাই একটু তাড়াতাড়ি আসে। একটি ফোন কলে শোনা যায়, – ‘আপনার পা ধরি ভাই, দয়া করে কিছু লোক পাঠান।’ আয়োজনের ধরন দেখে মনে হলো, সরকারই গোপনে আন্দোলনকারীদেরকে এ ধরনের আয়োজন করার দায়িত্ব দিয়েছে, যাতে তারা আন্তর্জাতিকভাবে দেখাতে পারে যে জনগণ আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা চায়।
এখন প্রশ্ন হলো, জনগণ বলতে কত মানুষকে বোঝায়? ৫৪ হাজার বর্গমাইলের দেশে ১৮ কোটি মানুষ বাস করে বলে ড. ইউনুস সাহেবরা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বলেন। তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪৪ হাজার মানুষ বাস করে। আর ড. ইউনুস সাহেব যদি ৩-৪ হাজার মানুষকে কোথাও জমায়েত করে বলেন যে জনগণ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে চায়, তা কি সারা পৃথিবীর মানুষকে বোকা ভাবার শামিল নয়? যেমন কেউ যদি বলে ২০০ x ৪০ = ১০ কোটি, তেমনি ৪ হাজার লোকের সমাবেশকে জনগণের চাওয়া হিসেবে দেখানোকে মানুষ বাটপারি বলবে না? ইতিমধ্যে মানুষ তথাকথিত এই সুধীজনদের কাল্পনিক উন্নয়নের প্রকৃতি এবং অন্যদেরকে দুর্নীতিবাজ বলার কৌশল বুঝে ফেলেছে। কারণ এ ধরনের স্বপ্ন দেখানো লোকেরা যে কত বড় প্রতারক হতে পারে, মানুষ তা বুঝতে পেরেছে। একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী, নোবেল বিজয়ীকে মানুষ অনেক উত্তম, সৃজনশীল ও ন্যায়পরায়ণ মনে করত, কিন্তু বাস্তবে তিনি কত বড় প্রতারক, দায়িত্ব দেওয়ার পর মানুষ তা বুঝতে পারল। এ জন্যই নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, “যত নামিদামি হোক, তাকে দায়িত্ব দিয়ে দায়িত্ব পালন শেষে ভালো বলো।”
ড. ইউনুস সাহেব ৫ই আগস্টের পরে প্রথম বাংলাদেশে এসে প্রায়ই বলতেন যে তিনি এই দায়িত্ব নিতে চাননি, শুধু দেশের স্বার্থে মানুষের অনেক বিনীত অনুরোধে দায়িত্ব নিয়েছেন। এখনও মাঝে মাঝে সুবিধাজনকভাবে একই কথা বিভিন্ন সময় বলেন। কিন্তু সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সামনে নিউইয়র্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, “শেখ হাসিনার পতন এমনি এমনি হয়নি। এটি তাদের দীর্ঘদিনের নিখুঁত কর্মপরিকল্পনার ফসল।” প্রথম দিকে এটাও বলতেন যে যত দ্রুত সম্ভব জনগণের চাহিদার মতো জন প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবেন। আবার বললেন, ছাত্ররাই তার নিয়োগকর্তা এবং তাদের বাইরে তিনি যেতে পারবেন না। এই কথা বলার পরপরই তিনি এই তথাকথিত ছাত্রদেরকে দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন মর্যাদাশীল প্রতিষ্ঠানে, যেমন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদার স্থান প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা করতে পাঠান, ভাঙচুর করেন এবং পরিবারের সবাইকে ভয় দেখান ও প্রধান বিচারপতিসহ অনেক বিচারককে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করান। আইনবহির্ভূত ইচ্ছা পূরণের জন্য যেখানে প্রয়োজন, তিনি তথাকথিত ছাত্রদেরকে দলবদ্ধভাবে পাঠিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের লোকদের উপর আক্রমণ ও মারধর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তথাকথিত বিপ্লবীরা যা বলেন, তা করতে হবে। যা ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি ও হিটলার তাদের শাসনামলে ইতালি ও জার্মানিতে করেছিলেন।
এই ধারাবাহিকতায় এখন গ্রামে গ্রামে এক শ্রেণির যুবক দলবদ্ধ হয়ে লুট, চাঁদাবাজি, হত্যা এবং এমনকি পুলিশ, প্রশাসনের লোকজন ও শিক্ষকদেরকে অপমান ও নারী ধর্ষণ করছে, কিন্তু কোনো প্রতিকার করার কেউ নেই। পুলিশ বলে এদের বিরুদ্ধে তাদের কিছু করার নেই। পারলে এই মুহূর্তে চাকরি ছেড়ে দিত, কিন্তু চাকরি ছাড়লে তো জেলেই দেবে।
সরকারের এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ কিছু করতে পারছে না। কিছুদিন পূর্বে সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনীকে চাকর এবং সেনানিবাস আক্রমণ করার কথা পর্যন্ত বলেছে, যা কোনো কালেও কেউ শোনেনি। পুলিশ কর্মকর্তাদের জেল ও চাকরিচ্যুতির ভয় দেখিয়ে ব্যবহার করছেন। যখন সবাই দেখছে পুলিশের আইজি, সচিব, মন্ত্রী-এমপিদেরকে হাতকড়া পরিয়ে চোর-ডাকাতের মতো লাইন করে কোর্টে আনা-নেওয়ার এই জঘন্য প্রথা ৫৪ বছরের বাংলাদেশে কেউ দেখেনি। পৃথিবীর কোথাও কেউ দেখেছে বলে জানা নেই। পুলিশ ভয়ে ড. ইউনুসের সরকারের কথা অনুযায়ী নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই সব নিষ্ঠুর কাজ করছে। দলমত নির্বিশেষে সবাই ভিতরে ভিতরে ভাবছে, এ কী নিষ্ঠুরতা তারা দেখছে, এতে করে তার প্রতি দিন দিন ভয় বাড়ছে।
কোনো পত্রিকা, টেলিভিশন কোনো খবর প্রচার করছে না। তথাকথিত ছাত্রদের দিয়ে ভয় দেখিয়ে, পিটিয়ে আহত করে এবং অনেক সাংবাদিককে জেলে পাঠিয়ে জামিন না দেওয়ার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে তাদের অপছন্দের খবর পরিবেশন করলে পরিণতি ভয়াবহ হবে। অতএব, অন্তর্বর্তী সরকার যা চায়, শুধু তাই করে। আর রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী। ড. ইউনুস বিএনপিকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে তার সরকার যা করছে, সবই বিএনপির লাভের জন্য এবং বিএনপি আওয়ামী লীগের লোকদের যত বেশি নিপীড়ন ও অত্যাচার করবে, ততই বিএনপির লাভ হবে এবং তার প্রশাসন পুরোপুরি বিএনপি ও জামায়াতের লোকদের সহযোগিতা করবে। এর ফলস্বরূপ, জামায়াত ও বিএনপি গ্রাম ও উপশহরগুলোতে অসংখ্য অত্যাচার করার ফ্রি লাইসেন্স পেয়ে যায়। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের লোকজন অপরাধ না করলেও তাদেরকে গ্রেফতার করতে হবে এবং জেলে পাঠাতে হবে, কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের লোকজন যত অপরাধই করুক না কেন, কিছু বলা যাবে না। কোনো কোর্টে আওয়ামী লীগের উকিল কাজ করতে পারবে না এবং সরকারের পক্ষের লোকজন যা চাইবে, সে অনুযায়ী কোর্ট চলবে। এরকম যখন দেশের অবস্থা এবং সরকার যখন বুঝতে পেরেছে যে বিএনপিকে দিয়ে আওয়ামী লীগের উপর যত বেশি নির্যাতন করানো যায়, ততই সরকারের লাভ। মানুষ বিএনপিকে খারাপ বলবে এবং জনগণ তাদের পক্ষ ত্যাগ করবে, অতএব তাদের সরকারের বাইরে যাওয়া নিরাপদ নয়।
এর মধ্যে ড. ইউনুস সাহেব ক্ষমতায় থাকার জন্য বাংলাদেশকে বিদেশিদের কাছে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে উপহার দিয়েছেন। বিদেশি অস্ত্রের চালান আসছে, বাংলাদেশের ভূখণ্ড সেন্টমার্টিনে বাংলাদেশিদের যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর বিদেশিদেরকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে শোনা যায়। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ একমাত্র দল, যারা জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে তা সরকারের জন্য বিপদজনক হবে। যে কারণে দ্রুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুধু দুঃখ এই যে, নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৩০ লক্ষ লোকের রক্তের বিনিময়ে যে দেশের জন্ম হয়েছে, বঙ্গবন্ধু কাউকেও দেশের এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দেননি। আজ সেই দেশ বিদেশিদের পদানত। যে দলের নেতৃত্বে এই দেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, সেই দল আজ ফাঁসির কাষ্ঠে।
ধন্যবাদ আমার জাতিকে, যারা আমার ২ লক্ষ মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে, ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে, তাদের সাথে আমাদের গভীর বন্ধুত্ব। এই জন্যই আমাদেরকে মীর জাফরের রক্তের উত্তরাধিকার বলা হয়।
এটাকে বলে জাতীয় বেইমান।