ঢাকা শহরসহ সারাদেশের মানুষ আতঙ্কিত, চরম নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করছে। বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাও বলছেন-কারো নিরাপত্তা নাই। তিনিও ৫ই আগস্টের পর থেকে নিরাপদ বোধ করছেন না। এই অবস্থার কারণ অনুসন্ধানের জন্য গত প্রায় ১মাস বহু জায়গায় ঘুরে এবং বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে কথা বলে যে স্পর্শকাতর বিষয়গুলো জানা গেলো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হল- পুলিশ প্রশাসনের উপর অমানুষিক নির্যাতন ও নিপীড়ন। তাই পুলিশ নিয়ে লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং পুলিশ ডিপার্টমেন্টের উচ্চ থেকে সকল স্তরের সাথে কথা বলে কারণ গুলি চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি , যদি বর্তমান ক্ষমতাসীনদের চেতনা হয়।
আইন শৃঙ্খলার মূল দায়িত্ব পালন করে পুলিশ প্রশাসন। পুলিশ সম্পর্কে যত বিতর্কই থাকুক না কেন - পুলিশ ব্যতিত সভ্য রাষ্ট্র অকল্পনীয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব পুলিশকে পেশাদারী হিসাবে গড়ে তোলা। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও ভেদাভেদ মুক্ত সুশাসনেই পারে উন্নত মানব কল্যানকামী পুলিশ গড়া। বি. এ. সিদ্দিক সাহেব (বাড়ি চট্টগ্রামে) যখন আইজিপি ছিলেন, তখন একটি অনুষ্ঠানে থেকে বের হওয়ার সময় আমি বললাম- আইজিপি সাহেব পুলিশের এতো স্বল্পতা, পূরণ করতে নতুন নিয়োগকৃতদের ৬ মাস বা ১ বছরের প্রশিক্ষণ দিয়ে পোস্টিং দিলেই এই জরুরি পুলিশ সঙ্কট সমস্যা সমাধান হয়ে যায়? তিনি উত্তরে বললেন যে, পুরো পৃথিবী গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে- মানুষকে পুলিশে রূপান্তরিত করতে ন্যূনতম দুই বছর প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশকে দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতার জন্য আইন বিধি/উপবিধিও বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে দায়িত্ব প্রদান করানো হয়।
গত ৫০/৫২ বছরের বাংলাদেশের সব সরকারের মেয়াদকালে মানুষ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেছে এবং সব সময় উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জন্য পুলিশকে মাঠে মোতায়ন করা হয়েছে। অতীতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে গিয়ে পুলিশ এবং আন্দোলনকারী উভয়পক্ষে দুঃখজনক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আন্দোলনের কারণে অতীতেও কখনও কখনও সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনের পরে নতুন এবং পুরনো যেই সরকার ক্ষমতায় থাকুক না কেন, পরবতীতে পুলিশের দায়িত্ব পালন বিষয় বিশেষভাবে মূল্যায়ণ করা হত। পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পুলিশের সমাবেশে উপস্থিত হয়ে পুলিশের বিরোচিত কাজের প্রশংসা করে উৎসাহ দিতেন এবং দায়িত্বে অবহেলা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের শাস্তির কথা বলতেন। তাতে পুলিশ সদস্যরা ”ভাল করলে পুরস্কার আর খারাপ করলে শাস্তির” বিষয় ধারনা লাভ করতেন।
এবারের আন্দোলনের সময় পুলিশের উপর অমানবিক নির্যাতন, অসংখ্য পুলিশ হত্যা, ৫/৭ হাজার পুলিশ আহত হয়েছেন। প্রায় ৪০০ এর অধিক থানা ভাঙচুর ও পুলিশকে মারধর করে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে পুলিশ হত্যার ঘটনা ঘটেছে, ছাত্র জনতার নামে পুলিশ মেরে ব্রিজে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সংঘবদ্ধভাবে পুলিশকে ধরে গুদাম ঘরে নিয়ে বিভৎসভাবে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ বাহিনী আশা করেছিল এই জঘন্য নিষ্ঠুর কাজের বিপরীতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের পাশে দাঁড়িয়ে বলবে এই জঘন্য ঘটনার বিচার হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাপারে আমরা সমব্যথী ,যারাই হত্যা বা অপরাধ করেছে তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হবে। সরকারি দায়িত্ব পালনকালে যারা হতাহত হয়েছে রাষ্ট্র তাদের পূর্ণ দায়িত্ব নিবে। হায়!
সরকারের কেউ একটুও খবর নিলনা? একটু সান্তনাও দিল না,আহতদের চিকিৎসার ব্যাপারে কেউ দেখভাল করলেন না। উল্টো ফরমান জারি করলেন, নৃশংস পুলিশ হত্যার বিচার হবে না। অন্যদিকে আহতরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কখন তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। কেন পুলিশের প্রতি এই নিষ্ঠুরতা। পুলিশ সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেছে। দোষ হলে, সরকারের যারা নির্দেশ দিয়েছেন তাদের বিচার করেন। পুলিশ তো যন্ত্র, সরকার যেভাবে চালায় সেভাবেই চলে। কোন দুর্ঘটনায় যন্ত্রের ব্যবহার হলেও যন্ত্রকে শাস্তি দেওয়া হয় না, দেওয়া হয় যন্ত্র চালককে। পুলিশ যদি সরকারের নির্দেশের বাইরে কিছু করে থাকেন তাহলে তার বিচার করেন।
পুলিশের সদস্যরা মনের কষ্টে, অন্ধকার গভীর রাতে বোবা কান্না করেন, ভয়ে দিনে কান্না করেন না। যেসব পুলিশকে হত্যা করা হয়েছে, যাদেরকে জেলে দেওয়া হয়েছে তাদের সন্তান যখন বাবার জন্য কান্নায় বুক ফাটায় তখন অন্য কর্তব্যরত পুলিশের সদস্যরা তার সন্তান, বাবা-মার কথা মনে করে, কান্না করে আল্লাহর কাছে বিচার দেন। কি অপরাধ তাদের? তারাতো রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করতে গিয়েছিল। প্রতিদিন জীবন বাজি রেখে দিন-রাত দায়িত্ব পালন করেছেন।
সরকারি কর্মচারী সরকারের আদেশ পালন করতে বাধ্য। যদি প্রশ্ন করা হয়- গত সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে নি। এটা বিচার করার দায়িত্বতো পুলিশের নয়। যারা যেভাবে ক্ষমতায় আসুক না কেন ( যেমন- খোন্দকার মোস্তাক/জেনারেল জিয়াউর রহমান/জেনারেল এরশাদ/খালেদা জিয়া) প্রত্যেক নির্বাচন নিয়েই বিতর্ক ছিল। সব সময় ক্ষমতার বাইরে যারা থাকতেন তারা ক্ষমতাসীনদের ফ্যাসিষ্ট বলেছেন। এখন যারা ক্ষমতায় তারা কিভাবে ক্ষমতায় আসলেন এই প্রশ্ন পুলিশ করতে পারে না। এখন রাষ্ট্রপতি ফরমান জারি করেছেন তাই ক্ষমতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এখন কোথাও আন্দোলন, গণ্ডগোল, ধর্মঘটের প্রেক্ষিতে শান্তি শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার কাজ করতে গেলে এখনোও পুলিশের উপর হামলা হয়, দায়িত্বের অংশ হিসেবে নির্দেশ অনুযায়ী গুলি চালাতে হয়। তাতে কেউ আহত বা নিহত হচ্ছে। এটা পুলিশের খারাপ লাগলেও দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতার অংশ হিসাবে এই নিষ্ঠুর কাজটি তাদের করতে হয়। যদি তাদেরকে দোষী করা হয়-তাহলে এখন যে সমস্ত হুকুম হচ্ছে সেটাও কি তাদেরকে বুঝে, বিবেচনা করে পালন করতে হবে? তাহলে কি দেশ চলবে? গত ৫০ বছরে বিশৃঙ্খলা মোকাবেলায় পুলিশের গুলিতে অনেক লোকই মারা গেছেন। তদন্ত হয়েছে কোন পরিস্থিতিতে পুলিশ গুলি করেছে? পুলিশকে গুলি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল কিনা তার? বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী যে কোন বৈধ অস্ত্রধারীকে তার ব্যবহৃত প্রতিটি বুলেটের যুক্তিযুক্ত ব্যবহারের হিসাব দিতে হয় এবং আদালত কর্তৃক সত্যতা নিশ্চিত করতে হয়। বাস্তবতা হল কোন আন্দোলনকারী, বিশৃঙ্খলাকারীর জন্য যদি জনগণের জীবনহানীর আশঙ্কা দেখা দেয় তখন পুলিশ ভয় দেখানোর জন্য গুলি ছুড়ে, তাতে মানুষের দুঃখজনক মৃত্যুও হয়। বিগত জুলাই আগষ্টে আন্দোলনের সময় পুলিশ রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে যাতে কারো মৃত্যু না হয়। তখন যে ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তা পর্যালোচনা করলে ভিতরের আশ্চর্যজনক ঘটনা জাতিকে অবাক করবে। কিন্তু পুলিশের ব্ক্তব্য কোন তদন্ত না করে গত ৫০ বছরে এই প্রথম কর্মরত আইজিপি, সাবেক আইজিপি, সাবেক বর্তমান স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশ কমিশনার, ডেপুটি পুলিশ কমিশনার, ইনেসপেক্টর কনস্টেবলদেরকে ঢালাওভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য দিকে বিভিন্ন থানায়, গুদাম ঘরে, পুলিশ মেরে ব্রিজে ঝুলিয়ে, পুলিশের মানসিক শক্তি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের কথা- আপনারা বড় মানুষ, হৃদয় না থাকতে পারে, সুন্দর কথার সাথে অনুভূতির মিল না থাকতে পারে কিন্তু সরকারের নির্দেশে তো পুলিশ যন্ত্রের মত কাজ করে, করতে হয়। পুলিশ আর্তনাদ করছে পুলিশকে বাঁচান তাদের কি অপরাধ বলুন? তারাতো সরকারের নির্দেশে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আর একটা বিষয় সবসময় দলীয়, পছন্দ, অপছন্দের কারণে চাকুরীতে পদোন্নতি, পদায়নের কমবেশি আলোচনা হয়েছে কিন্তু এখন যেভাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ভাগ করা হয়েছে, এটা কখনোই হয় নাই। অন্যদিকে অনেকের বিভিন্ন অপরাধ, অসৎ আচরণ, অযোগ্যতার কারণে ভালো পোস্টিং পদোন্নতি হয় নাই। এখন দলীয় দোহাই দিয়ে ১৫ দিনে ৩/৪ প্রমোশন, ভালো পোস্টিং দেওয়া হচ্ছে। পুলিশসহ সব প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির এটি একটি অন্যতম কারণ। ঢাকার বাইরে কোথাও পুলিশ অপরাধী নিরপরাধী বিবেচনায় কাজ করতে পারে না- জামায়াত, বিএনপির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে হয়।
পরিশেষে বলতে হচ্ছে, পুলিশের মনোবল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। উল্লেখিত বিষয়গুলি অনুযায়ী দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে পুলিশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। অতএব সাধু সাবধান।