হতবাক হয়ে ভাবছি সত্যিই কি আমরা ধ্বংস হয়ে যাব? ধ্বংস হয়ে যাওয়ার জন্য সব কিছুই কি বুঝে শুনে করছি? মনের মধ্যে অনেক কষ্ট। এদেশের মানুষ সারাজীবন এক মুঠো ভাতের জন্য আত্মচিৎকার করেছে, রাস্তাঘাট ব্রিজ কালভার্ট কিছুই ছিল না – ৮৫ ভাগ মানুষের ১৫/১৬ বছর আগেও বিদ্যুৎ ছিল না। মনে কষ্ট হয় এই ভেবে যে- একবার ধ্বংস হলে আবার ৪০/৫০ বছরে এই জায়গায় ফিরে আসতে পারবো না। যারা ধ্বংসের নেতৃত্বে আছেন, সবাই না বুঝলেও, কেউ বুঝেনা এটা মানা কষ্টকর। তারপরও কেন এই জঘন্য পরিণতির দিকে যাওয়া বন্ধ হয় না, হচ্ছে না। এ কথা ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল- ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে বেনজির ভুট্টোর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্বেও তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার একটা কথা প্রচার হচ্ছিল। তখন “পারষ্টান ইকোনোমি রিভিউ” পত্রিকা পাকিস্তানের বিষয়ে একটি আর্টিকেল ছেপেছিল যা তখন সিঙ্গাপুরে Strand Hotel এ বসে পড়ে জানলাম যে, ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মির্জাকে উৎখাত করে আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রপতি হন। ইস্কান্দর মির্জা বাংলাভাষি, মুর্শিদাবাদের অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তিনি পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নেন এবং ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত পাটের পৃথিবীতে ব্যাপক চাহিদা, যেমন বর্তমান আরব দেশগুলো তেল রপ্তানি করে যে পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা-ডলার রোজগার করছে তার মতই অর্থ আয় হতো পূর্ব পাকিস্তানের পাট রপ্তানি থেকে। এজন্য পাটকে সোনালী আঁশ বলা হতো। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের এই সোনালী আঁশকে প্রক্রিয়াজাত করে ব্যপক অর্থ কামানোর সুযোগ পাওয়ার জন্য আদমজি জুট মিলসহ শত শত শিল্প কারখানা স্থাপন করেন। পৃথিবীতে তখন পাট ছাড়া এখনকার মত প্লাস্টিকের ব্যাগ (Artificial fiber) তৈরির উন্নত প্রযুক্তি ছিল না। ঐ সময় পৃথিবীতে বহু যুদ্ধ চলমান ছিল। বিভিন্ন পন্যের প্যাকেজিংয়ে ব্যবহার ছাড়াও, যুদ্ধের বাঙ্কার তৈরিতে পাটের ব্যাগের (বালি ভরে ব্যবহার করত) চাহিদা ছিল ব্যাপক। যুদ্ধরত দেশগুলো পাটের বস্তার জন্য বেকুল হয়ে থাকত। তাই যে ব্যাগ আজকে ১০০ ডলার আগামীকাল ৩০০ ডলার পরের দিন ৭০০/৮০০ ডলার এমন কি ৩ দিনের ব্যবধানে ২০০০ ডলারেও বিক্রি হয়েছে ।
সে কারণে পূর্ব পাকিস্তানের পাট রপ্তানি করে পাকিস্তান অনেক বেশি আয় করেছে। আর এই আয়ের কারনে ১৯৬০ দশকে এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তান ২ নম্বর অর্থনৈতিক দেশ আর জাপান ১ নম্বর অর্থনৈতিক দেশ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু পাট রপ্তানির ব্যাপক আয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে হলেও তার সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় হতো। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি এই বৈষম্য নিয়ে অসন্তোষ এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় আইয়ুবের ব্যাপক অনিয়ম/অবিচারের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষও আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ঐ অবস্থায় আইয়ুব খাঁন ক্ষমতায় টিকে থাকার উদ্দেশ্যে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য তখন ভারতের বিরুদ্ধে বিনা কারণে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচারের জন্য একদল সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও তার সাথে সম্পৃক্ত সুযোগ সন্ধানী বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়োজিত করেন। যাতে মানুষকে ভারত বিদ্বেষী করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত অবস্থায় নেওয়া যায়। গণ অসন্তুষ্টির পাশাপাশি ভারত বিদ্বেষী অবস্থা তুঙ্গে নিয়ে ১৯৬৫ সালে আগষ্ট মাসে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। তাতে গণ অসন্তোষ আইয়ুব খানের পরিবর্তে ভারতের বিরুদ্ধে নেওয়ার সুবিধা হিসাবে আইয়ুব খান ক্ষমতায় থাকা দীর্ঘায়িত করতে সক্ষম হন। কিন্তু এর ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যায়। সে সময় এশিয়ার ২য় অর্থনীতির দেশ ধীরে ধীরে পিছাতে থাকে আর পাকিস্তান থেকে বহু পিছিয়ে থাকা এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর, হংকং, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ উপরে উঠে যায়। আর বর্তমানও পাকিস্তানের অবস্থা এশিয়ায় সব থেকে পিছনে। বর্তমানে পাকিস্তান পৃথিবীতে ৪৬তম, আর ভারত ৫ম অর্থনৈতিক দেশ। উল্লেখ্য ২০০৮ সালের বাংলাদেশে ছিল পৃথিবীতে ৫৫ তম অর্থনৈতিক দেশ। আর যোগ্য স্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থার কারণে ২০২৩ সালে পৃথিবীতে বাংলাদেশ ৩৫ তম অর্থনৈতিক দেশের গৌরবোজ্জ্বল স্থান দখল করে। ২০০৮ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৫৬৪ ডলার আর বর্তমানে ২৬২৪ ডলার যা ভারত, পাকিস্তান, নেপাল থেকে বেশি। যেখানে ২০০৮ সালে জিডিপি ছিল ১১০ বিলিয়ন ডলার আর ২০২৪ শে জুনে হয়েছে ৫০০ বিলিয়নের বেশি।
যত অর্থনৈতিক সূচক আছে সবগুলোই সারা পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশের অগ্রগতি ছিল অভাবনীয়। এর পিছনে আমার অভিমত হচ্ছে, দুর্নীতি ছিল, রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল, সম্প্রীতির অভাব ছিল, বৈষম্য ছিল, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ঘাটতি ছিল, পক্ষপাতিত্বও ছিল কিন্তু আজকের বাংলাদেশের মতো এত সর্বনাশা অবস্থা ছিল না। আজকে সমাজে, প্রশাসনে, বিচার বিভাগে, দেশের অভ্যন্তরে সকল খাতে মারাত্মক সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে যা ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট।
তার উপর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে বৈরীতা সৃষ্টির উস্কানি মানে আইয়ুবের পদাঙ্ক অনুসরন করে ১৭ কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেওয়ার মতোই।