মানব জীবন বড় বিচিত্র। এই বৈচিত্র্য থেকে কিছু কিছু মানুষ বহু আত্মত্যাগের বিনিময়ে মানব সভ্যতার বিশাল ইমারত তৈরি করে মানুষকে কল্যাণমুখী সমৃদ্ধ জীবন উপহার দিয়েছে। যদি শত হাজার বছর পূর্বের কথা ভাবি, দেখব স্রষ্টার সেরা সৃষ্টি মানুষ কত নিষ্ঠুরতায় ক্ষতবিক্ষত ও প্রতারিত হয়েছে। অন্যদিকে পৃথিবীতে মানবদরদী কত আত্মত্যাগ স্বীকার করে জীবন উৎসর্গ করেছেন, মানুষের উন্নতির জন্য। সেই স্বল্প সংখ্যক মানুষের আত্মত্যাগের কারণে আজকের পৃথিবীর এতো সমৃদ্ধি। সেরকম একজন মহীয়সী নারীর জন্মদিন উপলক্ষে এই লেখাটি বিবেকের তাড়নায় লিখতে বসলাম বটে, কিন্তু নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে এ কারণে যে, আমরা তাঁকে বা তাঁদেরকে যথাযথ মর্যাদা দিতে পারি নাই। তবু নিজের প্রতি কাপুরুষোচিত মন নিয়ে লিখতে বসলাম যাঁর সম্পর্কে, তিনি বেগম ফজিলাতুন্নেছা। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী মরহুমা বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি জন্মেছিলেন গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায়। তাঁর ডাকনাম ছিল রেণু। কিন্তু জন্মের সময় কেউ কি জানত যে, সময় ব্যবধানে শত বেদনা, দুঃখকষ্টকে মোকাবিলা করার কঠিন পথ অতিক্রম করে জীবনসঙ্গীকে একটি জাতির জন্ম দেওয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হবেন?
শুধু কি তাই, তাঁর ঔরসে জন্ম নেওয়া পাঁচটি সন্তান। বাংলার মানুষ মনে করত, বঙ্গবন্ধুর পাঁচটি সন্তান জাতির বড় আশীর্বাদ। কিন্তু কী নির্মম পরিহাস! ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সনে সব পুত্র সন্তান, বঙ্গমাতা ও বঙ্গবন্ধুর সাথে ৩২ নম্বরে ধানমন্ডির বাড়িতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। বেঁচে যাওয়া দুই সন্তানের মধ্যে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
বড় কন্যা শত প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে পিতা সোনার বাংলা গড়ার দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশে আসেন। শত যন্ত্রণা-অপমান সহ্য করে বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে পিতার স্বপ্ন পূরণের জন্য দুর্বার গতিতে চলছিলেন। দশকের পর দশক ক্ষমতায় এসেই প্রথম খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, শতভাগ মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া, শতভাগ শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করেন, বড় বড় প্রকল্পের পাশাপাশি শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, প্রতিটি মানুষের আয় বৃদ্ধি, হতদরিদ্র দেশকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই কয়েক দিন পূর্বে আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা "মাহাথির মোহাম্মদ" বলেছিলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যেভাবে উন্নতি হচ্ছিল, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো দেশ হয়ে যেত। কিন্তু বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে বাংলাদেশ ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে, এটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর এক বছর অতিক্রম হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ শেখ হাসিনার জন্য কান্নাকাটি করছে। তারই গর্বিত মাতা বাঙালি জাতির এক মহীয়সী নারী- বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু স্ত্রী-ই ছিলেন তাঁর শক্তি ও অনুপ্রেরণার উৎস। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে অন্তরালে থেকে বঙ্গবন্ধুর শক্তি ও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু যখন জেলে থাকতেন, তখন তাঁর অবর্তমানে সংগঠন পরিচালনায় প্রধান সমন্বয়কারীর গুরুদায়িত্ব পালন করতেন বঙ্গমাতা। জেলগেটে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গিয়ে নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর দিতেন। আবার জেলগেট থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত দিক-নির্দেশনাও নেতা-কর্মীদের কাছে পৌঁছে দিতেন তিনি। তিনি সবসময় বঙ্গবন্ধুকে উজ্জীবিত করেছেন, ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলার পরামর্শ দিতেন। তাঁর ত্যাগ, নিষ্ঠা বঙ্গবন্ধুকে নির্ভীকচিত্তে দেশের কাজ করতে সাহায্য করেছে। আবার সংসারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নির্ভীকচিত্তে শতভাগ দেশ ও দেশের জনগণের জন্য কাজ করতে সাহায্য করেছেন বঙ্গমাতা। বলা যায়, বঙ্গবন্ধু, বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গমাতা একইসূত্রে গাঁথা।
বেগম মুজিব সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছেন— "তাঁর স্ত্রীর মতো সাহসী মেয়ে খুব কমই দেখা যায়। আমাকে যখন পিন্ডির ফৌজ বা পুলিশ এসে জেলে নিয়ে যায়, আমার উপর নানা অত্যাচার করে, আমি কবে ছাড়া পাব বা কবে ফিরে আসব ঠিক থাকে না, তখন কিন্তু সে কখনো ভেঙে পড়েনি। আমার জীবনের দুটি বৃহৎ অবলম্বন। প্রথমটি হলো আত্মবিশ্বাস, দ্বিতীয়টি হলো আমার স্ত্রী।" জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে তিনি প্রশ্নহীনভাবে সমর্থন দিয়েছেন, মনোবল ও সাহস জুগিয়েছেন, অপরিসীম প্রেরণা জুগিয়েছেন। এর সবই তিনি করে গেছেন একান্ত নিভৃতে থেকে। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় এবং দুর্ভিক্ষের সময় তাঁর স্বামী যখন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, বিভিন্নভাবে মানুষের সেবা করেছেন, তাঁর সাথে একইরকম মনোভাব নিয়ে সার্বক্ষণিক সমর্থন দিয়ে গেছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা। এমনকি যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের প্রচারণা ও সার্বিক কর্মকাণ্ডে অপরিসীম সহযোগিতায় বেগম মুজিবকে একান্তভাবে যুক্ত থাকতে দেখা যায়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন করতে রাস্তায় নেমে লিফলেট বিতরণ করেছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো কারান্তরালে কাটিয়েছেন বছরের পর বছর। তাঁর অবর্তমানে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করা, আন্দোলন পরিচালনা করা— প্রতিটি কাজে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বেগম মুজিব। তিনি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের বলিষ্ঠ সংগঠক ছিলেন নেপথ্যে থেকে। তাঁর স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল, আন্দোলন চলাকালীন প্রতিটি ঘটনা জেলখানায় সাক্ষাৎকারের সময় বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশ নিয়ে আসতেন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সেই নির্দেশ জানাতেন। সংগোপনে বঙ্গবন্ধুর নিকট থেকে প্রাপ্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পৌঁছে দিতেন আওয়ামী লীগের কার্যকরী সংসদের সভা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে। সভা চলাকালীন তিনি রান্না করে খাদ্য পরিবেশনের ব্যবস্থা করতেন। এ সংগঠনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করার কাজে তাঁর অবদান অপরিসীম। পুলিশ ও গোয়েন্দার চোখ এড়িয়ে সংগঠনকে সংগঠিত করতেন, ছাত্রদের নির্দেশ দিতেন, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেন।
মাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা লিখেছেন— "জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি, আমার বাবা কারাবন্দি। মা তাঁর মামলার জন্য উকিলদের সঙ্গে কথা বলছেন, রাজবন্দি স্বামীর জন্য রান্না করে নিয়ে যাচ্ছেন, গ্রামের শ্বশুর-শাশুড়ি ও আত্মীয়-স্বজনের খবরাখবর রাখছেন। আবার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করছেন, যারা বন্দি তাদের পরিবারের খোঁজখবর নিয়ে টাকাও পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কারাগারে দেখা করতে গিয়ে স্বামীর কাছে বাইরের সব খবর দিচ্ছেন এবং তাঁর কথাও শুনে আসছেন। কাউকে কিছু জানানোর থাকলে ডেকে জানিয়েও দিচ্ছেন। এরপর আছে তাঁর ঘর-সংসার। এরমধ্যে ছেলেমেয়েদের আবদার, লেখাপড়া, অসুস্থতা, আনন্দ-বেদনা সবকিছুর প্রতিও লক্ষ্য রাখতেন। এতকিছুর পরও তাঁর নিজের জন্য সময় খুঁজে নিয়ে তিনি নামাজ পড়ছেন, গল্পের বই পড়ছেন, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করছেন। কী ভীষণ দায়ভার বহন করছেন! ধীর-স্থির এবং প্রচণ্ডরকম সহ্যশক্তি তাঁর মধ্যে ছিল। বিপদে, দুঃখ-বেদনায় কখনো ভেঙে পড়তে দেখিনি। বরং সেখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজতে চেষ্টা করেছেন— এটাই ছিল তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা, তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রকাশ।" ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার পরিবর্তে বাংলাদেশে পতাকা উত্তোলন নিয়ে বঙ্গবন্ধু দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। এর আগের দিন ২২ মার্চ রাতে খেতে বসে বঙ্গবন্ধুকে চিন্তাক্লিষ্ট দেখে বেগম মুজিব জানতে চেয়েছিলেন— "পতাকা ওড়ানোর ব্যাপারে কি কোনো সিদ্ধান্ত নিলেন?" বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "না, নিতে পারিনি। আমি পতাকা ওড়াতে চাই। একটাই ভয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এখনো ঢাকায়। সে বলবে, আলোচনা চলা অবস্থাতেই শেখ মুজিব নতুন পতাকা উড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এ অজুহাত তুলেই তারা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সামরিক হামলা চালাবে।" এ অবস্থায় বেগম মুজিব পরামর্শ দিয়েছিলেন, "আপনি ছাত্র নেতাদের বলুন আপনার হাতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিতে। আপনি সেই পতাকা বত্রিশ নম্বরে ওড়ান। কথা উঠলে আপনি বলতে পারবেন, আপনি ছাত্রজনতার দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন।" এর আগে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের আগে একই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। দলীয় নেতাকর্মী ও বিভিন্ন পক্ষের নানামুখী প্রস্তাব ও পরামর্শে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া না দেওয়া নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত বঙ্গবন্ধুকে তিনি বলেন, কারও পরামর্শ না শুনে নিজে যা সঠিক মনে করেন, তাই বলতে। যেন সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। বঙ্গবন্ধু তাই করেছিলেন। এমনই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, "আমি তোমাদের মা"। অনেক বীরাঙ্গনাকে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে বিয়ে দিয়ে সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন জীবন দান করেন। সেই বাঙালির মা বেগম মুজিব এই দেশের জন্মের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কণ্টকাকীর্ণ পথে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদান ও গুরুত্ব নিয়ে যতটা আলোচনা হওয়ার কথা তা হয়নি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে নয়, একজন নীরব দক্ষ সংগঠক হিসেবে যিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন তিনি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি ১৯৩০ সালের ৮ই আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। এই মহীয়সী নারীর জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছার উচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সনদ না থাকলেও অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন। কিশোর বয়স থেকে শুরু করে আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে তাঁকে সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী ও কর্মময় জীবনে তাঁর পাশে ছায়া হয়ে থেকেছেন, তাঁকে সাহায্য সহায়তা করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু যেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে ইতিহাসের অংশ হয়েছেন, তেমনি শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তাঁর আন্দোলন-সংগ্রামের প্রত্যক্ষ অংশীদার, ভুক্তভোগী ও প্রেরণাদাত্রী হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ যা অস্বীকার করা অসম্ভব। প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর জেলে থাকা অবস্থায় বেগম মুজিব ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সংগঠিত রাখতেন। তাদের পরামর্শ ও টাকা-পয়সা দিয়ে সহায়তা করতেন। তাঁর স্মরণশক্তিও ছিল প্রখর। মাঝে মাঝে জেলগেটে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে পার্টির খবরাখবর দিতেন এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনাবলি শুনে এসে পার্টির লোকদের জানাতেন। বাংলার কাদা-জল ও গ্রামীণ পরিবেশ থেকে উঠে আসা একজন গৃহিণী শেখ মুজিবের সংস্পর্শে এসে সম্পূর্ণ রাজনীতি সচেতন, করিৎকর্মা নারী হয়ে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিটি সংগ্রামে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অসামান্য অবদান রয়েছে। আমার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সারাজীবন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশের মানুষের জন্য চিন্তা করতে প্রেরণা জুগিয়েছেন।’ বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী লেখার পেছনেও রয়েছে বেগম মুজিবের অবদান ও অনুপ্রেরণা। তিনি জেলগেটে একদিন স্বামীকে বলেন, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবন কাহিনি।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আরও লিখেন- ‘আমার স্ত্রী যার ডাকনাম রেণু, আমাকে কয়েকটা খাতা কিনে জেলগেটে জমা দিয়েছিলেন। জেল কর্তৃপক্ষ যথাযথ পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’ বঙ্গবন্ধুর এ উক্তি থেকে বোঝা যায়, খুঁটিনাটি বিষয় থেকে কত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে বেগম মুজিবের অবদান ছিল। বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন হিসেব করলে দেখা যায়, তিনি জীবনের ১৩ বছরের অধিক সময় কারান্তরালে কাটিয়েছেন। ১৯৪৯ সালের শেষদিকে কারারুদ্ধ হয়ে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক নাগাড়ে দুই বছরেরও বেশি সময় তাঁকে কারাগারে থাকতে হয়েছে। ১৯৫৮ সালের পর তাঁকে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রায় ১৪ মাস কারান্তরালে রাখা হয়। মাঝে মাঝেই তাঁর দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে বেগম মুজিব একদিকে সংসার সামলিয়েছেন, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করেছেন, অন্যদিকে পার্টির লোকজন ও ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। বঙ্গবন্ধু অনেক সময় ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতেও দলীয় সভা করতেন। সে সময় বেগম মুজিব নিজে রান্না করে লোকদের খাইয়েছেন। ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন এবং পরবর্তীতে ১৯৬৮-৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর জেলে থাকাকালীন ছাত্র-জনতার আন্দোলন সংগ্রামে তিনি নেপথ্য থেকে নেতৃত্ব ও পরামর্শ দিয়েছেন। ছাত্র ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ওই সময় প্রায়ই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে এসে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নিতেন। অসীম ধৈর্য ও দেশপ্রেমের অধিকারী বেগম মুজিব নানা সংকটে সংসার নির্বাহসহ ছেলেমেয়েদের লালন-পালন ও লেখাপড়া চালাতে গিয়ে কষ্ট করেছেন। কোনোদিন স্বামীর প্রতি অভিযোগ দূরে থাক, বরং আপসহীন সংগ্রামে স্বামীকে উৎসাহ দিয়েছেন। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের পর ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে পশ্চিম পাকিস্তান যাওয়ার জন্য সরকার মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তাঁকে প্যারোলে মুক্ত করতে রাজি হন। কিন্তু বেগম মুজিব বড় মেয়ে শেখ হাসিনার মাধ্যমে ক্যান্টনমেন্টে বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর পাঠান বঙ্গবন্ধু যেন প্যারোলে মুক্তি না নেন। সরকার তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিলেই তিনি গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করবেন।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বেগম মুজিবের ভূমিকার বিষয়ে তাঁদের কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহানা স্মৃতিচারণে লিখেছেন- ‘জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি আমার বাবা কারাবন্দি। মা তাঁর মামলার জন্য উকিলদের সঙ্গে কথা বলছেন, রাজবন্দি স্বামীর জন্য রান্না করে নিয়ে যাচ্ছেন, গ্রামের শ্বশুর-শাশুড়ি ও আত্মীয়-স্বজনের খবরাখবর রাখছেন। আবার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করছেন, যারা বন্দি তাঁদের পরিবারের খোঁজ খবর নিয়ে টাকাও পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কারাগারে দেখা করতে গিয়ে স্বামীর কাছে বাইরের সব খবর দিচ্ছেন এবং তাঁর কথাও শুনে আসছেন। কাউকে জানানোর থাকলে ডেকে জানিয়েও দিচ্ছেন। এরপর আছে তার ঘর সংসার। এরমধ্যে ছেলেমেয়েদের আবদার, লেখাপড়া, অসুস্থতা আনন্দ-বেদনা সবকিছুর প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হয়। এতকিছুর পরও তাঁর নিজের জন্য সময় খুঁজে নিয়ে তিনি নামাজ পড়েছেন, গল্পের বই পড়েছেন, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করছেন। আমার মা কী ভীষণ দায়ভার বহন করেছেন। ধীরস্থির এবং প্রচণ্ড রকম সহ্যশক্তি তার মধ্যে ছিল। বিপদে, দুঃখ বেদনায় কখনো ভেঙে পড়েননি।’ একজন শ্বাশত বাঙালি স্ত্রী ও মায়ের প্রতিচ্ছবির পাশাপাশি ফুটে ওঠে তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা ও অসাধারণ কর্তব্যপরায়ণতা। বেগম মুজিবের প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা না থাকলেও তিনি ছিলেন অতিশয় বুদ্ধিমতী ও রাজনীতি সচেতন। নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তিনি বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিতেন। ১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে প্রতিদিন ছাত্র-জনতা মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যেতেন। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা প্রদর্শন করা হয়। ২২ মার্চ রাতে খেতে বসে বঙ্গবন্ধুকে কিছুটা চিন্তিত দেখে বেগম মুজিব জানতে চান, ‘পতাকা ওড়ানোর ব্যাপারে কি কোনো সিদ্ধান্ত নিলেন?’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘না নিতে পারিনি। আমি পতাকা ওড়াতে চাই। একটাই ভয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এখনো ঢাকায়। পাকিস্তানিরা বলবে, আলোচনা চলা অবস্থাতেই শেখ মুজিব নতুন পতাকা উড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এ অজুহাত তুলে তারা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সামরিক হামলা চালাবে।’ এ অবস্থায় বেগম মুজিব পরামর্শ দিলেন- ‘আপনি ছাত্র নেতাদের বলুন আপনার হাতে পতাকা তুলে দিতে। আপনি সেই পতাকা ৩২ নম্বরে ওড়ান। কথা উঠলে আপনি বলতে পারবেন, আপনি ছাত্র-জনতার দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন।’ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের জানিয়ে দেন ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে তিনি ৩২ নম্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়াবেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ নয় মাস মুজিব পরিবার বন্দি ছিলেন ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে। বঙ্গবন্ধু তখন পশ্চিম পাকিস্তানে কারাবন্দি। স্বামীর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে গভীর অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা সত্ত্বেও তিনি সীমাহীন ধৈর্য, সাহস ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। পাকিস্তানি সেনাদের বুঝতে দেননি দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছেন। বাসায় দু’মেয়ে ও ছোট ছেলে রাসেলকে আগলে রেখেছেন। স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী থাকা কালে নিজ স্ত্রীর সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছেন- ‘আমার স্ত্রীর মতো সাহসী মেয়ে খুব কমই দেখা যায়। আমাকে যখন পিন্ডির ফৌজ বা পুলিশ এসে জেলে নিয়ে যায়, আমার ওপর নানা অত্যাচার করে, আমি কবে ছাড়া পাব বা কবে ফিরে আসব ঠিক থাকে না, তখন কিন্তু সে কখনো ভেঙে পড়েনি।’
শেখ ফজিলাতুন্নেছা আজীবন বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন, সুখ-দুঃখের সাথী হয়েছেন এবং উনিশশো পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর সাথেই শাহাদাতবরণ করেন। নিয়তির বিধানে বঙ্গবন্ধুর জীবন সাথী মরণেও সাথী হলেন। শেখ ফজিলাতুন্নেছা একদিকে যেমন ছিলেন স্নেহময়ী মা- সন্তানদের লালনপালন ও শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে বড় করেছেন, অন্যদিকে ছিলেন স্বামীর রাজনীতির প্রেরণাদাত্রী ও পরামর্শক। শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা পরবর্তীতে জাতির পিতা হওয়ার সংগ্রামে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তাই তিনি বঙ্গমাতা।