ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচার, বৈষম্য, গণহত্যা, স্বাধীনতা এই শব্দগুলো ইদানিং নতুন করে ব্যাপক ব্যবহার হওয়া আরম্ভ হয়। এই শব্দগুলি কোন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির নামের সাথে ইচ্ছা করলেই ব্যবহার করতে পারেন। যেমন আপনি ইচ্ছে করলে একজন চোরকে ভালো মানুষ বলতেই পারেন বা একজন ভালো মানুষকে চোর বলতেই পারেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানিকভাবে এই বিশেষণ গুলি ব্যবহার করতে হলে আপনাকে প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবহার করতে হবে। তেমনি উল্লেখিত বিশেষণ যার সাথে যেটা যায় সেটা ব্যবহার করা দায়িত্বশীলদের নৈতিক দায়িত্ব।
ফ্যাসিজম রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি মতবাদ যা ১৯২১ সালে বেনিটো মুসোলিনির নেতৃত্বে ইতালিতে প্রথম বাস্তবায়ন হয়। বেনিটো মুসোলিনি একজন শিক্ষক, সাংবাদিক, নভেলিস্ট ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এমন ভাবে দেখাতে সক্ষম হন যে, সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে মানুষ তার পিছনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকে ক্ষমতায় বসান। ক্ষমতায় যাওয়ার পর পূর্বসূরীদের সম্পর্কে গল্প অতিরঞ্জিত করে ব্যাপক প্রচার করেন। উদ্দেশ্য হলো সকল প্রতিপক্ষ সম্পর্কে ভুল ধারণার মাধ্যমে তাদেরকে জনশূন্য করে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা। কেউ ন্যূনতম সমালোচনা করলে তাদেরকে ভয়-ভীতি ও মিথ্যা মামলার দিয়ে নিষ্ঠুর জীবন যাপন করতে বাধ্য করা । রাষ্ট্রে মানুষের মধ্যে বিভক্তির মাধ্যমে দ্বন্দ্ব এবং একদলকে দিয়ে আরেক দলকে দমন করার কৌশল। ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণের ইচ্ছার দোহাই দিবে কিন্তু জনগণের কোন মতামতে চলবে না, সরকার প্রকাশ্যে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলবে কিন্তু তার বিরুদ্ধে যায়, এমন কিছু প্রকাশ করলে তার রুটি রুজি ও সামাজিকভাবে তাদেরকে ধ্বংস করে দিবে । মানুষের উপর এই নির্যাতনের কথা কোন মিডিয়া প্রকাশ করতে পারত না।
মুসোলিন ও হিটলারের সময় কেউ তাদের চাহিদা মত কাজ না করাকে দুশমন বলে প্রচার এবং দলীয় লোক জড় হয়ে জঙ্গি স্টাইলে ভয় ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে পদচ্যুতি নিত্য দিনের কাজ ছিল। আইন, সংবিধান সেকালের এবং মানুষের জন্য কল্যাণকর নয় বলে তাকে বাতিল করে দেওয়া এবং নতুন আইন সংবিধান রচনার কথা বললে বাস্তবে কিন্তু কোন আইন থাকে না। এটা মুসোলিনি ও হিটলার উভয়েই করছেন।
বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনেক বেশি প্রচার করে নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী কিছু লোককে দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত করা। আর একই ধরনের বা তার চেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজ নিয়ে দুর্নীতি নির্মূলের জন্য অভিযান পরিচালনা করা। বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকারের বিষয়ে প্রচার থাকবে কিন্তু আপনি অত্যাচারিত হলে বা আপনার প্রতি অবিচার হলে কোন কথা বলতে পারবে না। রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে বৈষম্য সৃষ্টি করা, তাদের অপছন্দের লোকজন যত ধরনের অত্যাচারিত হোক না কেন তারা আইনের আশ্রয় পাবে না। বাক স্বাধীনতা অর্থাৎ আপনি সরকারের সমালোচনা, অত্যাচারিত বা বঞ্চিত হওয়ার ব্যাপারে প্রতিবাদ করার স্বাধীনতার কথা প্রচারে থাকবে কিন্তু বাস্তবে প্রতিবাদ করলে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হতো।
গণহত্যা শব্দটির অর্থ হলো কোন জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে নির্বিচারে হত্যা করাকে গণহত্যা এবং কোন দেশ, অন্য দেশ বা অংশ যদি দখল করে রাখে, তখন সে দেশের নাগরিকরা তাদের দেশকে দখল মুক্ত করতে গেলে দখলদারাও সেখানকার স্বাধীনতাকামী মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করাকেও গণহত্যা বলা হয়। যেমন ১৯৭১ সনে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইরত মানুষকে ৯ মাসের পাকিস্তানি সৈনিকেরা ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছে। তাই এটাকে গণহত্যা বলা হয়। বিভিন্ন পরাধীন দেশ বিভিন্নভাবে স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তান থেকে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ লোকের জীবন আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম দিতে হয়েছে। পাকিস্তানের সর্বশেষ সামরিক শাষক জেনারেল ইয়াহিয়া ১৯৭০ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। তখন পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন মাওলানা ভাসানীসহ কিছু দল নির্বাচন বর্জন করলেও নির্বাচনের ফলাফল সমস্ত পাকিস্তানে ৩০০ জাতীয় পরিষদের আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ১৬২ থেকে ১৬০ টি আওয়ামীলীগ আর পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৮ টি আসনের মধ্যে জুলফিকার আলীর দল মাত্র ৮০টি এবং অন্য অনেক ছোট ছোট দলগুলি বাকি আসন পায়।
পূর্ব পাকিস্তানের ৩০০ টি প্রাদেশিক পরিষদ আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থীরা পায় । তখন পাকিস্তানের সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের সকল আলোচনা বন্ধ করে ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অপারেশন সার্চ লাইট ডিক্রি জারি করে। পাকিস্তানি সৈনিকরা কামান, ট্যাঙ্ক নিয়ে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা আরম্ভ করলে, জনগণের ভোটে ক্ষমতা প্রাপ্ত নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু আইনসম্মতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঐ ঘোষণাপত্র ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মেহেরপুর আম্রকাননে গণপরিষদের সভায় পাশ করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি ও তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ১৭ই এপ্রিল রচিত খসড়া সংবিধানের উপর নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যগণ শপথ গ্রহণ করেন। সরকার তখন এম এ জি ওসমানীকে সেনা প্রধান নিয়োগ করে মেজর জলিল, মেজর জিয়া, মেজর মঞ্জুরকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন। সৈনিক, ছাত্র, সরকারি কর্মচারী, কৃষক, শ্রমিক সবাই সকল ভেদাভেদ ভুলে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে বলা ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ করার আহ্বানকে বুকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেন। এখন কিছু ছাত্র চাকুরীতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে মানুষের সমর্থন ছিল কিন্তু পরবর্তীতে এটাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অদৃশ্য শক্তির সহযোগিতায় সরকার প্রধানকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করে। তাই বলে এটাকে বিপ্লব বা স্বাধীনতা বলা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু না ।
তাদের এরকম আস্ফালন দেখে একটি গল্পের কথা মনে হলো গল্পটা হল "এক সুন্দরী রমণী বিয়ের পর স্বামীকে নিয়ে দূরে বেড়াতে যাচ্ছেন পথে ডাকাত ও কিছু হিংস্র জীবজন্তু মোকাবেলা করে সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছার পর পথে তার এই বীরত্বের কথা বার বার বলাতে স্ত্রী বিরক্ত হয়ে ঝগড়ার করে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। পরে স্ত্রী দ্বিতীয় বিবাহ করে একইভাবে দ্বিতীয় স্বামীকে নিয়ে দূর দেশে বেড়াতে যাওয়ার পথে স্বামী কিছু পিঁপড়া আর মশা মেরে বারবার যখন নিজের বীরত্বের কথা স্ত্রীকে বলছিল তখন স্ত্রী ভাবতে আরম্ভ করলো কি পাগলের সাথে পড়লাম, আগের জন তো বাঘ ভাল্লুক মেরে বীরত্বে দেখালে বিরক্ত হয়েছিলাম আর এখন এতো মশা মেরে যে পরিমাণ বীরত্ব দেখাচ্ছে তাতে এই পাগল থেকে বাঁচার জন্য কি আত্মহত্যা করবো?" বাংলাদেশেরও অবস্থাটা এমনই হয়েছে। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে অবজ্ঞা করে এখন কোটা আন্দোলনকে স্বাধীনতা বলার মনে ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা বোনের আত্মত্যাগের প্রতি অসম্মান করা।
হিটলার ও মুসোলিনি দুইজনই তাদের শাসনকালীন সময় যেখানেই তাদের মতের বিরুদ্ধে যায় এমন কোন কাজ কেউ করলে তাদেরকে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাৎক্ষণিক তাদেরকে অপমান, ভয় ভীতি প্রদর্শন পূর্বক জোর করে চাকুরীজীবি, বিচারপতি আইন, শৃঙ্খলায় নিয়োজিত ব্যক্তিদেরকে পদত্যাগে বাধ্য করতেন ও রাষ্ট্রের কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে তাদের পক্ষে ও বিপক্ষে বিভক্ত করে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করতেন। পদোন্নতি পদায়ানে পক্ষের বিপক্ষের লোক বলে প্রকাশ্যে ঘোষনা দিতেন এবং সে হিসাবে পদায়ন ও পদোন্নতি দিতেন। পক্ষের হলে কোন নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে ও অযৌক্তিকভাবে একাধিক এবং অপ্রয়োজনীয় পদোন্নতি দিতেন।
বর্তমানে জনপ্রতিনিধি, শিক্ষকদেরকে পক্ষ বিপক্ষ বিভক্তি ও মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা এবং আইন শৃঙ্খলা ভেঙে দিয়ে তাদের দলীয় লোকদেরকে দিয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্বরত শিক্ষকদেরকে পদত্যাগ ও অপমান করে বহিস্কার করা। গোটা দেশের মানুষকে রাজনৈতিক, সামাজিকভাবে নিপীড়নের মাধ্যমে অসহায় করে ফেলা। ফ্যাসিজমের নিকৃষ্ট উদাহরণ হিটলার ও মুসোলিনি শাসন আমলে যা যা করা হয়েছে এবং হুবহুব একই ধরনের সব কাজ বর্তমান ইউনুস সরকার ও তার তথাকথিত ছাত্রদেরকে ও সহযোগী রাজনৈতিক সংগঠনদেরকে দিয়ে করিয়াছেন বা করাচ্ছেন।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসন আমলে জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, মানুষ যে কোন সময় তুলনায় ভালো ছিল কিন্তু কিছু কিছু যেমন ব্যাংক খাত ও শেয়ার বাজার অনিয়ন্ত্রিত ছিল। এই জন্য তাকে কি ফ্যাসিস্ট বলা যায়? হিটলার ও মুসোলিনি যা করেছে যেমন দলীয় লোক পাঠিয়ে ভয় দেখিয়ে প্রধান বিচারপতি ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর, কলেজের প্রিন্সিপাল, স্কুলের প্রধান শিক্ষককে অপমান করে পদত্যাগে বাধ্য করা, ১৫ বছরে প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীর বাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া, পুলিশকে নিষ্ঠুরভাবে গলা কেটে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা, থানার বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে পুলিশ হত্যা, পুলিশের আইজিপি, সচিব ও উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদেরকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো এমন ঘটনা গত ৩ মাসে অসংখ্য হয়েছে, হচ্ছে। যা হিটলার ও মুসোলিনির শাসন আমলকেও হার মানিয়েছে। কিন্তু গত ১৫ বছরে এরকম একটা উদাহরণও নাই। এই নিষ্ঠুরতা মুসোলিনি ও হিটলারের শাসন আমলে আর গত ৩ মাসে বাংলাদেশে হয়েছে। তাই ফ্যাসিস্ট কে বা কারা বিচারের ভার আপনাদের উপর দিলাম।